শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ১০:০৯ পূর্বাহ্ন
চিররঞ্জন সরকার:
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও রাষ্ট্রের নাগরিক। সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রের সব নাগরিকের সমান অধিকার রয়েছে। রাষ্ট্রের সব আইন সব নাগরিকের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু আমাদের দেশে সরকারি কর্মচারীরা এতদিন বিশেষ ‘সুবিধা’ ভোগ করত। তাদের বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা হলে গ্রেপ্তারের জন্য বিভাগীয় অনুমতির প্রয়োজন হতো। যা ছিল সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো আইন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বাতিল হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের দেশে এমন অনেক আইন ও বিধান এখনো চালু আছে। যেমন চালু ছিল সরকারি কর্মচারীদের গ্রেপ্তারে কর্র্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি নেওয়ার বিধানটি। অবশেষে সরকারি চাকরি আইনের ৪১ (১) ধারা সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিবেচনা করে বাতিল ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। গত ২৫ আগস্ট বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এ রায় দেয়।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের নভেম্বরে সরকারি চাকরি আইন প্রণয়ন করা হয়। ২০১৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে একই বছরের ১ অক্টোবর থেকে আইনটি কার্যকর হয়। এ অবস্থায় সরকারি কর্মচারীদের বিশেষ সুবিধাসংক্রান্ত আইনের ৪১ (১) ধারাটি সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদের পরিপন্থী উল্লেখ করে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে ২০১৯ সালের ১৪ অক্টোবর হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর হাইকোর্ট রুল দেয়। রুলে সরকারি চাকরি আইনের ৪১ (১) ধারাটি কেন সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদের পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। এ সংক্রান্ত রুলের ওপর শুনানির পর অবশেষে হাইকোর্ট এই রায় ঘোষণা করে। হাইকোর্টের এই রায়টি নানা দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। এই রায়ের ফলে, ফৌজদারি অভিযোগে অভিযুক্ত সরকারি কর্মচারীদের গ্রেপ্তারের আগে পূর্বানুমতি লাগবে না।
এর আগে সরকারি চাকরি আইন ৪১ (১) ধারার মতো একই ধরনের বিশেষ সুবিধা দিয়ে আনা বৈষম্যমূলক বিধান রেখে ২০১৩ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ৩২ (ক) ধারা প্রণয়ন করা হয়েছিল। এ নিয়ে রিট হলে আইনটি বৈষম্যমূলক ঘোষণা করে হাইকোর্ট বাতিল করেছিল।
আমাদের দেশে ক্ষমতাসীনরা সব সময় আমলাদের তোয়াজ করে চলে। তাদের নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে, ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যবহার করা। তা না হলে এমন বিধান সরকার কীভাবে করে? সুস্পষ্ট অপরাধের প্রমাণ পেলেও ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না এটা তো স্পষ্টতই দায়মুক্তি, যা জংলি বিধান। অপরাধকে উসকে দেওয়া কিংবা উৎসাহিত করারও বিধান। হাইকোর্ট সময়োচিত এ রায় দিয়ে কিছুটা হলেও নৈতিকতার পরিচয় দিয়েছে। এ ধরনের বৈষম্যমূলক আইন কোনো সভ্য দেশে থাকতে পারে না। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেহেতু জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বেতন ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন এবং জনগণের খেদমতের জন্য তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। তাই জনগণের কাছে তাদের দায়বদ্ধতা থাকা উচিত। যদিও বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজেদের বিরাট ক্ষমতাবান বা ‘রাজা’ মনে করেন। গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশে তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেশের জনগণকে ‘প্রজা’ হিসেবে দেখেন, যা খুবই দুঃখজনক। তারা যে জনগণের সেবক, এই দৃষ্টিভঙ্গিটা বিকশিত ও প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন।
সরকারি চাকরিজীবীদের জীবনমানে উন্নতি ও দুর্নীতি কমাতে ২০১৫ সালে বেতন-ভাতা দ্বিগুণ করে সরকার, ২০১৬ সালের ১ জুলাই যা কার্যকর হয়। বেতন-ভাতা বাড়িয়ে সরকারের তরফে বলা হয়েছিল, নতুন কাঠামোতে বেতন দ্বিগুণ হওয়ায় সরকারি কর্মচারীদের জীবনমান বাড়বে, ফলে দুর্নীতি কমবে। কিন্তু বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বলছে, দুর্নীতি কমেনি। দুদকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দুর্নীতির মামলায় ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে দুদক। তাদের মধ্যে ৪ শতাধিক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। গত দুই বছরে দুর্নীতিসংক্রান্ত যত অভিযোগ জমা হয়েছে, তার প্রায় অর্ধেকই সরকারি দপ্তরসংক্রান্ত।
বছর পাঁচেক আগে দুর্নীতি দমন কমিশন বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ও অধিদপ্তর-সংস্থার অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক অনুসন্ধানে নেমেছিল। নিয়োগ, বদলি, একই অফিসে বছরের পর বছর পোস্টিং, নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতিসহ অসংখ্য অভিযোগে অন্তত ৫ শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর একটি তালিকা প্রণয়ন করেছিল। যারা অবৈধভাবে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। সে সময় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ভূমি অধিদপ্তর, রাজউক, পিডব্লিউডি, এলজিইডি, বিআরটিএ, বিআরটিসি, তিতাস গ্যাস, ওয়াসাসহ বেশ কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছিল, যেখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবৈধ পথে জিরো থেকে হিরো হয়েছেন খুব অল্প সময়ে। এসব অধিদপ্তর-পরিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলেও দুদকের অনুসন্ধানে বলা হয়েছিল। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বলা ভালো, ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। দুর্নীতি দমন কমিশনকে চুপ করিয়ে রাখা হয়। উল্লেখ্য, স্বাধীন ও মেরুদ-সম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুর্নীতি দমন কমিশন এখনো বিকশিত হতে পারেনি। সেই সুযোগও তাদের দেওয়া হয়নি।
আমাদের দেশে ব্যবসায়ী, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, আমলা ও রাজনীতিবিদরা মিলে দুর্নীতি ও লুটপাটের এক নতুন ব্যবস্থা চালু করেছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির ব্যাপারে তারা একে-অপরের সহযোগী ও রক্ষাকারী। মাঝে মাঝে অবৈধভাবে অর্জিত টাকা ভাগাভাগির ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ার কারণে ব্যবসায়ী, আমলাদের ধরা গেলেও ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিবিদরা থাকেন সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে। তারাও এক ধরনের ‘দায়মুক্তি’ ভোগ করেন। সংসদ সদস্যদেরও সরাসরি গ্রেপ্তার করা যায় না। তাদের গ্রেপ্তার করতে হলে স্পিকারের অনুমতি নিতে হয়। এটাও একটা বৈষম্যমূলক বিধান। সংসদ সদস্যদের গ্রেপ্তারে স্পিকারের অনুমতির বিধান কেন বাতিল করা হবে না? একথা সবাই জানে, যাদের হাতে ক্ষমতা আছে তারাই বেশি দুর্নীতি করে। ক্ষমতাহীনের দুর্নীতি করার সুযোগ কম। সেদিক থেকে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাবানরাই দুর্নীতি করে। প্রশ্ন হলো, আমাদের সমাজ থেকে দুর্নীতি উচ্ছেদের ন্যূনতম আগ্রহ কি ক্ষমতাসীনদের আছে? থাকলে সেই সদিচ্ছার প্রকাশ কোথায়?
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইনের শাসনের মূল কথাই হলো, আইনের চোখে সবাই সমান। সামন্ত শাসনামলে একসময় দেশের সাধারণ মানুষের জন্য ছিল এক আইন, আর রাজা-বাদশাহর পরিবারের জন্য ছিল আর এক আইন। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে ফৌজদারি অপরাধে আইনের চোখে যাতে সবাই সমান হয়, সে জন্যই ফৌজদারি কার্যবিধি করা হয়েছে। কাউকে আটক করা যাবে, আর কাউকে আটক করতে হলে অনুমোদন নিয়ে আসতে হবে, এটা আইনের মূলনীতির পরিপন্থী। জনগণের সন্তুষ্টি বা জনকল্যাণই সরকারের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। কোনো বিশেষ গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করার জন্য রাষ্ট্র পরিচালিত হতে পারে না।
মানুষ অতীতে নয়, বাঁচে বর্তমানে। দেখেও বর্তমানকে। এই বর্তমানের দুর্নীতিকে পর্দার আড়ালে ঠেলে দিয়ে অতীতের দুর্নীতি নিয়ে মুখর হলে কিন্তু সাধারণ মানুষ মোটেও খুশি হবে না। বরং তারা ক্ষমতাসীনদের ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়ার ন্যূনতম সুযোগ পেলেই লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে ফেলতে পারেন। ক্ষমতাসীনদের কি সেই হুঁশ আছে? নাকি জনসমর্থন ছাড়াই তারা অন্য কোনো ‘জাদুমন্ত্রের’ বলে অনন্তকাল ক্ষমতায় থাকার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছেন?
লেখক লেখক ও কলামিস্ট
chiros234@gmail.com